রোহিঙ্গাদের জন্ম হার নিয়ে উদ্বেগ, প্রতিদিন গড়ে ১২৫ শিশু জন্ম
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রতিদিনই বাড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশু জন্মের হার। উদ্বেগও বাড়ছে প্রতিদিনই। ৫ বছরে ১ লাখ ৫৮ হাজার জন্ম নেওয়া শিশুর নিবন্ধন করা হয়েছে কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে। বিভিন্ন এনজিও সংস্থার দেয়া তথ্যে বলা হচ্ছে প্রকৃত অর্থে গত পাঁচ বছরে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। ৫৮ শতাংশ শিশুর বয়স আঠারোর নিচে।
গত পাঁচ বছরে টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে জন্মলাভ করেছে প্রায় আড়াই লাখ শিশু। ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে মোট শিশুর সংখ্যা এখন প্রায় ছয় লাখ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালালেও তা তেমন একটা কাজে আসছে না।
এসব বিষয় গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘ -কে অনুরোধ করেছে পরিবার পরিকল্পনায় জোর দেওয়ার জন্য।
জনগোষ্ঠী হিসেবে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের অনিয়ন্ত্রিত শিশু জন্মদান স্থানীয়দের ভাবিয়ে তুলেছে। এমনিতে তারা শ্রমবাজার দখল করছে, গাছপালা, পাহাড়-বন উজাড় করেই চলছে। চাষাবাদ, ব্যবসা বানিজ্য থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে স্থানীয়দের সাথে পাল্লা দিয়ে লড়ছে। তার ওপর প্রতিদিন নতুন শিশুর আগমনে শঙ্কায় রয়েছে এলাকাবাসী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের এ অনিয়ন্ত্রিত শিশু জন্মদান শুধু উদ্বেগই বাড়াচ্ছে না; এসব শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি করছে শঙ্কা। কারণ ক্যাম্পের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তাদের বেড়ে উঠতে হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগ ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কল্যাণে ক্যাম্পের মধ্যে তাদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে; কিন্তু সেটিও সীমিত পরিসরে।
জাতিসংঘ শরাণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিসংখ্যান জানায়, বর্তমানে প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্ত হচ্ছে গড়ে ১২৫ শিশু। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে সাড়ে ১৪ লাখে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের মধ্যে একাধিক বিয়ে ছাড়াও বাল্যবিয়ের প্রবণতা বাড়ছে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে অধিক সন্তান জন্মদান বিরোধী নানা প্রচার-প্রচারণা চললেও বস্তুত সেটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গারা এভাবে সন্তান জন্ম দিতে থাকলে একদিন টেকনাফ-উখিয়াসহ কক্সবাজারজুড়ে স্থানীয় অধিবাসীরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে; পাল্টে যাবে জনমিতি।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৩টি ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ৫৮ হাজার। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত করা নিবন্ধনের হিসাব এটি। অনিবন্ধিত শিশুরা রয়ে গেছে এ হিসাবের বাইরে। ক্যাম্পগুলোতে আশ্রিতদের মধ্যে ৫৮ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অফিসের তথ্য বলছে, ২০১৭ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নারীদের মধ্যে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৩০০ পিল, পুরুষদের মধ্যে ৭৮ হাজার ৩২৫ কনডম বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ জনকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন প্রয়োগ ও ১৪ হাজার ৪৬২ জনকে ইমপ্লান্ট করা হয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অফিসের উপপরিচালক পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত করতে ক্যাম্পগুলোতে সর্বোচ্চ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তিনি জানান, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত মোট শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ৫৮ হাজার। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি এনজিওর ৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে স্থানীয় মসজিদগুলোর মাধ্যমে ইসলামের আলোকে সচেতনতা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তী স্বল্প সময়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসে। ওই সময় আসা নারীদের ৩৫ হাজারের বেশি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ফলে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই ক্যাম্পগুলোয় প্রচুর শিশুর জন্ম হয়। ইউএনএফপিএর আরেকটি তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ৩৫ হাজার অন্তঃসত্ত্বার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি সেবাকেন্দ্রগুলোতে মাত্র চার হাজার শিশুর জন্ম হয়। অবশিষ্ট শিশুর জন্ম হয় আশ্রয়শিবিরেই।
এর আগে শরণার্থীবিষয়ক এক সভায় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার কথা বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রতিবছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্মের তথ্য তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যদিও ইউএনএইচসিআরের তথ্য বলছে, শিবিরগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ হাজার শিশু যোগ হচ্ছে। বর্তমানে শিবিরের সাত শতাংশ শিশুর বয়স অনূর্ধ্ব চার বছর। ৫-১১ বছর বয়সী ১১ শতাংশ।
যথাযথ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও চলাফেরার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত এসব শিশুর মধ্যে অনেকেই ভুগছে তীব্র মানসিক অশান্তিতে। হতাশা ও ক্ষোভ থেকে অল্প বয়সেই কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাস, মাদক পাচারসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
১৯৯২ সালে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে শিশু বয়সে বাবার হাত ধরে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন মোহাম্মদ ইসলাম। এখন তার বয়স ৩৬ বছর। টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত শিবিরের নেতা মো. ইসলাম জানান, পরিবারের চার সদস্য নিয়ে বাবার হাত ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কয়েক বছর আগে বাবা মারা গেছেন। এখন তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৩ জন। হতাশাগ্রস্ত ইসলাম বলেন, ‘কাঁকড়ারও নিজস্ব স্থায়ী গর্ত (ঘর) আছে, কিন্তু আমাদের কোনো ঘর নেই। মিয়ানমার সরকার আমাদের এখনো জাতি হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়নি। আমার ৭টি সন্তান রয়েছে। ওদের নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। ওদের ভবিষ্যৎ কিছু দেখছি না, অন্ধকার ছাড়া। নয়াপাড়া শিবিরে প্রায় আট হাজার শিশু রয়েছে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে। তবে কাজটা খুব কঠিন।
রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি কার্যকর করা কঠিন জানিয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দৌজা নয়ন বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিল। ফলে এটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। এর পরও তাদের সচেতন করতে নানা কর্মসূচি চলছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
জানা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা শিশু পরীক্ষামূলক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে। মিয়ানমারের পাঠক্রম অনুসারে তাদের পাঠদান করা হচ্ছে। ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা প্রকল্প কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত বুলেটিনের তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ পাঠক্রমের আওতায় এসেছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৬ রোহিঙ্গা শিশু।
শরণার্থী শিবিরের শিক্ষা খাতের তালিকাভুক্ত কক্সবাজারের স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা প্রান্তিক উন্নয়ন সোসাইটির মানবিক সহায়তা কর্মসূচির সমন্বয়ক অনিমেষ বিশ্বাস অটল জানান, ইউনিসেফ ছাড়াও সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাকসহ স্থানীয় কিছু বেসরকারি সংস্থা বিকল্প অর্থায়নে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষাদানে কাজ করছে। পরিসংখ্যান বলছে ১৩ থেকে ১৭ বছরের ৫ শতাংশ শিশু (ছেলে মেয়ে) বিবাহিত। এক্ষেত্রে মেয়ে শিশুর সংখ্যাই বেশী।